২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তি জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশনের (জেসিপিওএ) অংশ হিসেবে রাখা হয়েছিল ‘স্ন্যাপব্যাক’ বা নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহালের ব্যবস্থা। এর উদ্দেশ্য ছিল ইরান চুক্তির শর্ত না মানলে যেন দ্রুত ও বাধাহীনভাবে জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা আবার কার্যকর করা যায়। কোনো পক্ষ ইরানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুললেই ৩০ দিনের মধ্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এ নিষেধাজ্ঞা চালু হতে পারে। এতে ইরানের বিদেশে থাকা সম্পদ জব্দ করা, অস্ত্র কেনাবেচায় নিষেধাজ্ঞা, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি সীমিত করা ও আন্তর্জাতিক লেনদেনে নানা বাধা দেয়ার মতো ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহালের প্রক্রিয়া বা ‘স্ন্যাপব্যাক’ ঘিরে আবারো আলোচনায় ইরান। চলতি সপ্তাহে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন চলছে। এর মধ্যেই দেশটির প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি নিষেধাজ্ঞা এড়াতে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। তবে সময়সীমা ফুরিয়ে আসছে। ফ্রান্স, জার্মানি ও যুক্তরাজ্য ইতোমধ্যে জানিয়েছে, ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তি মানছে না ইরান। এতে ইরানের অর্থনীতি ও আঞ্চলিক রাজনীতিতে নতুন চাপ তৈরি হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তি জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশনের (জেসিপিওএ) অংশ হিসেবে রাখা হয়েছিল ‘স্ন্যাপব্যাক’ বা নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহালের ব্যবস্থা। এর উদ্দেশ্য ছিল ইরান চুক্তির শর্ত না মানলে যেন দ্রুত ও বাধাহীনভাবে জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা আবার কার্যকর করা যায়। কোনো পক্ষ ইরানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুললেই ৩০ দিনের মধ্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এ নিষেধাজ্ঞা চালু হতে পারে। এতে ইরানের বিদেশে থাকা সম্পদ জব্দ করা, অস্ত্র কেনাবেচায় নিষেধাজ্ঞা, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি সীমিত করা ও আন্তর্জাতিক লেনদেনে নানা বাধা দেয়ার মতো ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত।

চলতি বছরের ১৮ অক্টোবরের পর স্ন্যাপব্যাক প্রক্রিয়া কার্যকর রাখার সুযোগ শেষ হয়ে যাবে। তাই সময় ফুরিয়ে যাওয়ার আগে ইউরোপীয় দেশগুলো এটি সক্রিয় করেছে। এরপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হলে নিরাপত্তা পরিষদে যেতে হবে, যেখানে চীন ও রাশিয়া ভেটো দিতে পারে। ফলে স্ন্যাপব্যাক সক্রিয় হওয়ার এ সিদ্ধান্ত ইরানের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করেছে।
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে পশ্চিমাদের উদ্বেগ কোথায়
ইরান বরাবরই দাবি করে আসছে, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ। তবে গত কয়েক বছরে দেশটির কর্মকর্তারা বারবার ইঙ্গিত দিয়েছেন যে প্রয়োজনে তারা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির দিকেও যেতে পারে। বর্তমানে ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে প্রায় অস্ত্র–গ্রেডের কাছাকাছি মাত্রায়। অথচ বিশ্বে কোনো দেশ পারমাণবিক অস্ত্র ছাড়াই এত উচ্চমাত্রার সমৃদ্ধকরণ করছে না বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
২০১৫ সালের চুক্তি অনুযায়ী ইরান সর্বোচ্চ ৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ পর্যন্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে পারত। মজুদের সীমাও নির্ধারণ ছিল ৩০০ কেজি। কিন্তু আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ) জানিয়েছে, এখন ইরানের কাছে প্রায় ৯ হাজার ৮৭৪ কেজি ইউরেনিয়াম মজুদ আছে। এর মধ্যে প্রায় ৪৪০ কেজি সমৃদ্ধ করা হয়েছে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত।
উল্লেখ্য, ইউরেনিয়াম প্রাকৃতিক অবস্থায় থাকে। কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদন বা অস্ত্র তৈরির জন্য এটিকে সমৃদ্ধ (এনরিচ) করতে হয়। সমৃদ্ধকরণ প্রক্রিয়ায় ধাতুটির ইউ-২৩৫ আইসোটোপের ঘনত্ব বাড়ানো হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এ পরিমাণ ইউরেনিয়াম দিয়ে একাধিক পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করা সম্ভব। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ধারণা করছে, ইরান এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে অস্ত্র কর্মসূচি শুরু করেনি। তবে তারা চাইলে খুব দ্রুত সে পথে এগোতে সক্ষম।
ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র
চলতি বছরের জুনে ইরানের বিরুদ্ধে বড় সামরিক অভিযান চালিয়েছে ইসরায়েল। এ অভিযানে যুক্তরাষ্ট্রও যুক্ত হয়। মূল লক্ষ্য ছিল দেশটির পারমাণবিক স্থাপনাগুলো। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নাতাঞ্জ স্থাপনা, যা রাজধানী তেহরান থেকে প্রায় ২২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এখানেই ইরান মূলত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করে আসছিল। ইসরায়েলের বিমান হামলায় নাতাঞ্জের ভূ-পৃষ্ঠের অংশ ধ্বংস হয়। পরে যুক্তরাষ্ট্রও ‘বাঙ্কার-বাস্টার’ বোমা ফেলে ভূগর্ভস্থ স্থাপনাগুলোতে আঘাত হানে। ধারণা করা হচ্ছে, আইএইএ যেসব সেন্ট্রিফিউজ ধ্বংস হওয়ার কথা বলেছে, সেগুলোও এতে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এছাড়া ফরদো স্থাপনাতেও একই ধরনের হামলা চালানো হয়। এখানে ভূগর্ভস্থ সুরক্ষিত কক্ষে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছিল ইরান। মার্কিন বাহিনী ইসফাহানের পারমাণবিক স্থাপনাতেও বোমা ফেলে। অন্যদিকে ইসরায়েল আলাদাভাবে আরাক ভারী পানি রিঅ্যাক্টরসহ কয়েকটি কেন্দ্রকে লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে।
ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক কেন এত খারাপ
একসময় ইরান ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র। শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভীর শাসনামলে তেহরান ও ওয়াশিংটনের মধ্যে সামরিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বেশ শক্তিশালী ছিল। পাহলভী ছিলেন ইরানের শেষ শাহ, যিনি ১৯৪১ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত দেশ শাসন করেন। ১৯৫৩ সালে সিআইএ’র সহায়তায় এক অভ্যুত্থান ঘটে। এর মাধ্যমে শাহ পাহলভীকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখা হয়।
কিন্তু ১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামি বিপ্লব সবকিছু পাল্টে দেয়। আয়াতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে নতুন ইসলামি সরকার গঠিত হয়। সে বছরই মার্কিন দূতাবাস দখল করে শিক্ষার্থীরা ৪৪৪ দিন ধরে জিম্মি করে রাখেন মার্কিন কূটনীতিকদের। তখন থেকেই দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়।
১৯৮০–এর দশকে ইরান-ইরাক যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে সাদ্দাম হোসেনকে সমর্থন দেয়। পারস্য উপসাগরে ‘ট্যাংকার যুদ্ধের’ সময় একদিনের অভিযানে মার্কিন নৌবাহিনী ইরানের নৌবাহিনীকে কার্যত অক্ষম করে দেয়। একই সময়ে ভুলবশত একটি ইরানি যাত্রীবাহী বিমান ভূপাতিত করে যুক্তরাষ্ট্র।
এরপর থেকে দুই দেশের সম্পর্ক উত্থান-পতনের মধ্যে ছিল। ২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তির পর কিছুটা উন্নতি হলেও ২০১৮ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে একতরফাভাবে চুক্তি থেকে সরিয়ে নেন। এর পর থেকে আবার উত্তেজনা বাড়তে থাকে। বর্তমানে গাজা যুদ্ধ ও ইসরায়েলের আঞ্চলিক হামলার কারণে সেই উত্তেজনা নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, জাতিসংঘের স্ন্যাপব্যাক কার্যকর হলে ইরানের অর্থনীতি আরো বড় চাপের মুখে পড়বে। এতে শুধু ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক নয়, পুরো মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিও অস্থির হয়ে উঠতে পারে। ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ, পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে হামলা ও দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব মিলিয়ে এ সংকট এখন শুধু পারমাণবিক নিরাপত্তার বিষয় নয়। এটি বৈশ্বিক শান্তির জন্যও বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শেয়ার করুন :










