বাংলাদেশি পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্র সংশোধিত পারস্পরিক বা পাল্টা শুল্ক নির্ধারণ করেছে ২০ শতাংশ। কিন্তু এর সঙ্গে বর্তমানের গড় ১৫ শতাংশ শুল্কও যোগ হবে। অর্থ্যাৎ, বাংলাদেশি পণ্যকে মার্কিন বন্দর পার হতে মোট ৩৫ শতাংশ শুল্ক গুনতে হবে। এই অর্থ ওই দেশের আমদানিকারকদের দিতে হবে। শেষ পর্যন্ত তা যাবে যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ ক্রেতাদের পকেট থেকে। এখন প্রশ্ন হলো, এই শুল্ক বা ট্যারিফ কীভাবে আদায় হয় এবং এর প্রভাব আমদানিকারক ও রপ্তানিকারক দেশের অর্থনীতিতে কীভাবে পড়ে।
শুরুতেই আসি গড় শুল্ক ও পারস্পরিক শুল্ক হার প্রসঙ্গে। জাতিসংঘের পশ্চিম এশিয়া অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশনের সংজ্ঞা অনুযায়ী, গড় শুল্ক বলতে বোঝায়, সমস্ত আমদানি মূল্যের সরল গড়। অর্থ্যাৎ, একটি দেশ তার আমদানিকৃত বিভিন্ন পণ্যের ওপর যেসব শুল্ক আরোপ করে সেটির গড় হলো ‘গড় শুল্ক’ হার। আর পারস্পরিক শুল্কের উদাহরণে সিবিসি নিউজ বলছে, যদি কোনো দেশ আমেরিকার তৈরি জুতার ওপর ৬ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে, তবে যুক্তরাষ্ট্র সেই দেশের জুতার ওপরও একই হারে শুল্ক আরোপ করতে পারবে। গত বছরের ২ এপ্রিলের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র মূলত দেশভেদে আমদানি-রপ্তানির ঘাটতির মাত্রার ওপর ভিত্তি করে পারস্পরিক শুল্ক নির্ধারণ করছে।
শুল্ক কীভাবে কাজ করে
শুল্ক কীভাবে কাজ করে তা বুঝতে হলে প্রথমে রপ্তানি ও আমদানির পার্থক্য জানা দরকার। রপ্তানি হলো সেই পণ্য যা একটি দেশ অন্য দেশে বিক্রি করে। আমদানি হলো সেই পণ্য যা একটি দেশ অন্য কোনো দেশ থেকে কিনে আনে। উদাহরণস্বরূপ, কানাডা যুক্তরাষ্ট্রে স্টিল ও অ্যালুমিনিয়াম রপ্তানি করে, আর যুক্তরাষ্ট্র এসব পণ্য কানাডা থেকে আমদানি করে। শুল্ক আরোপ করা হয় আমদানি করা পণ্যের ওপর এবং এটি বন্দরে কাস্টমস (শুল্ক বিভাগ) দ্বারা আদায় করা হয়।
শুল্কের টাকা কে দেয়
সরকার শুল্ক আদায় করে, কিন্তু নিজে দেয় না। যদি যুক্তরাষ্ট্র আমদানি করা পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করে, তবে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানিকারক সংস্থাগুলোকে সেই শুল্ক দিতে হয়। এই অতিরিক্ত খরচ পুষিয়ে নিতে আমদানিকারকরা গ্রাহকদের কাছে থেকে বেশি দাম নিতে পারে।
সোজা কথায়, শুল্কের ফলে বিদেশি পণ্যের দাম বেড়ে যেতে পারে। আর শেষমেশ এর খেসারত সাধারণ ক্রেতাকেই দিতে হয়। ধরুন, কানাডা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে চাল রপ্তানি করা হয়। যদি এই পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্র বাড়তি শুল্ক বসায়, তাহলে মার্কিন আমদানিকারক সেই শুল্ক দেবে। আর সেই বাড়তি খরচ পণ্যের চূড়ান্ত দামে যোগ করে ক্রেতাদের কাছে থেকে আদায় করবে। ফলে, যুক্তরাষ্ট্রে চালের দাম বেড়ে যাবে।
যেভাবে প্রভাব ফেলে
জিডিপি, আন্তর্জাতিক সাপ্লাই চেইন আপনার দৈনন্দিন চিন্তার বিষয় নাও হতে পারে। কিন্তু শুল্কের প্রভাব আপনি টের পাবেন মূল্যস্ফীতির মাধ্যমে। অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে মূল্যস্ফীতি কি? কয়েক বছর আগেও আপনি ৩০ টাকায় এক কেজি চাল কিনতে পারতেন। এখন মানভেদে চালের দাম ৬০ থেকে ৯০ টাকা। এই যে একই পরিমাণ পণ্য কিনতে বেশি টাকা খরচ হচ্ছে এটিই হলো মূল্যস্ফীতি।
যেহেতু আপনি বাজার ব্যবস্থার বাইরে নন, সুতরাং কোনো না কোনোভাবে আপনার জীবনযাত্রার ব্যয়ও বেড়ে যাবে। ধরুন, আপনি কানাডার নাগরিক। সে হিসেবে একটি উদাহরণ থেকে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হওয়া যাক। কানাডিয়ান চেম্বার অব কমার্স বলছে, যদি দেশটির ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ হয়, তাহলে জিডিপি (নির্দিষ্ট সময়ে দেশের অভ্যন্তরে উৎপাদিত পণ্য, পরিষেবার মোট বাজার মূল্য) ২ দশমিক ৬ শতাংশ কমে যেতে পারে। আর তখন একটি পরিবার বছরে গড়ে ১ হাজার ৯০০ কানাডিয়ান ডলার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
এবার বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে উদাহরণ দেওয়া যাক। মার্কিন বাজারে পোশাক রপ্তানিকারকদের মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ। কিছুদিন আগেও মেড ইন বাংলাদেশি পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করার সময় সে দেশের আমদানিকারকরা কাস্টমসকে গড়ে প্রায় ১৫ শতাংশ শুল্ক দিতেন। পরে এর ভিত্তিতে দেশটির বাজারে পোশাকের দাম নির্ধারণ করতেন। পারস্পরিক ২০ শতাংশ শুল্ক কার্যকরের পর মার্কিন ব্যবসায়ীরা যখন বাংলাদেশি পণ্য আমদানি করবেন তখন তাদের মোট ৩৫ শতাংশ শুল্ক পরিশোধ করতে হবে। তখন তারা এই বাড়তি শুল্কের ওপর ভিত্তি করে বাজারে বাংলাদেশি পোশাকের দাম নির্ধারণ করবেন। যেমন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আগে যে শার্ট ১০ ডলারে পাওয়া যেত, বাড়তি শুল্কের কারণে এর দামও বেড়ে যাবে।
বাংলাদেশে কেমন প্রভাব পড়বে
এ বিষয়ে ধারণা নেওয়া যাক সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুনের লেখা থেকে। সংস্থাটির ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা নিবন্ধের একাংশে ফাহমিদা খাতুন লিখেছেন, বাড়তি শুল্কের জন্য বাংলাদেশের সামনে চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ দুটিই তৈরি হয়েছে। চীনের ওপর নতুন করে ট্যারিফ আরোপের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়তে পারে। এর ফলে রপ্তানি আদেশ বৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে। ট্রাম্প প্রশাসনের প্রথম মেয়াদেও বাংলাদেশ একইভাবে চীনের ওপর আরোপিত শুল্কের প্রভাব থেকে উপকৃত হয়েছিল।
ফাহমিদা খাতুন লিখেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের আমদানিকারকরা যখন বেশি দামের পণ্যের পরিবর্তে বিকল্প উৎস খুঁজবে, তখন বাংলাদেশ বিশেষ করে টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস খাত রপ্তানি বাড়ানোর সুযোগ পেতে পারে। তবে এখানে একাধিক প্রতিযোগী দেশও থাকবে। যেমন ভিয়েতনাম, ভারত, ইন্দোনেশিয়া—যারা কানাডা, মেক্সিকো ও চীনের ফাঁকা বাজার দখলের চেষ্টা করবে। অন্যদিকে, শুল্কের কারণে যদি বিশ্ব অর্থনীতি মন্থর হয়, তাহলে বাংলাদেশি রপ্তানির সামগ্রিক চাহিদা হ্রাস পাওয়ার ঝুঁকিও আছে।
প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে কিছু পরামর্শও দিয়েছেন ফাহমিদা খাতুন। লিখেছেন, সুযোগ কাজে লাগানো ও দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকতে হলে বাংলাদেশকে বাণিজ্য নীতিমালা আরও আধুনিক ও শক্তিশালী করতে হবে। উৎপাদন দক্ষতা বাড়াতে হবে এবং রপ্তানি পণ্যের বৈচিত্র্য আনতে হবে।
কোন খাতে কেমন ঝুঁকি
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের বরাত দিয়ে আলজাজিরা জানিয়েছে, ট্রাম্পের শুল্কনীতি ঘোষণার পর প্রথম প্রান্তিকের আয় প্রতিবেদনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গাড়ি নির্মাতা, এয়ারলাইনস ও ভোক্তা পণ্য আমদানিকারকরা। অ্যালুমিনিয়াম ও ইলেকট্রনিক্স (যেমন, সেমিকন্ডাক্টর) এর ওপর ট্যারিফ আরোপের ঘোষণা উৎপাদন ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছে।
নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির স্টার্ন স্কুল অব বিজনেসের অর্থনীতির অধ্যাপক জোসেফ ফাউডি বলেন, ‘যখন ট্যারিফ ২০ শতাংশ বা এর বেশি হয়ে যায়, তখন এমন একটা পর্যায় আসে যেখানে কোম্পানিগুলো আমদানি পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে পারে। তারা বড় সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখে, নিয়োগ পিছিয়ে দেয় এবং সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হ্রাস পায়।’
অর্থনীতিবিদদের মতে, এখন পর্যন্ত যে ট্যারিফগুলো বাস্তবায়িত হয়েছে, এর পুরো প্রভাব বাজারে পড়েনি। কারণ অনেক প্রতিষ্ঠান আগেই মজুত বাড়িয়ে নিয়েছিল যাতে ব্যয় বাড়ার আগেই উৎপাদন বা বিক্রি চালু রাখা যায়।
কীভাবে প্রস্তুতি নেবেন
ট্যারিফের পূর্ণ প্রভাব সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বোঝা যাবে। কিন্তু সাধারণভাবে ট্যারিফ অর্থনীতিতে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি করে। এ ক্ষেত্রে আপনি কী করবেন? আপনি যা করতে পারেন তা হলো ব্যক্তিগত আর্থিক ব্যবস্থাপনার ওপর নজর দেওয়া। যাতে, চারপাশ অস্থির থাকলেও আপনি কিছুটা স্বস্তিতে থাকতে পারেন।
ব্যবসায়ীদের জন্য কানাডার বহুজাতিক ব্যাংকিং ও আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান স্কটিয়া ব্যাংকের পরামর্শ হলো, বিনিয়োগ অব্যাহত রাখা। বিনিয়োগ না করার হাজারো কারণ থাকতে পারে। খবরের নেতিবাচক শিরোনাম উপেক্ষা করে দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য সামনে রেখে বিনিয়োগে স্থির থাকাটা একজন ব্যবসায়ীকে সঠিক পথে রাখতে সাহায্য করবে।
রপ্তানি শিল্পে মন্দা দেখা দিলে এর প্রভাব পড়তে পারে সাধারণ কর্মীদের ওপরও। তাই স্কটিয়া ব্যাংক বলছে, সাধারণ কর্মীদের উচিত নিজের বর্তমান আর্থিক অবস্থা স্পষ্টভাবে বোঝার চেষ্টা করা। অর্থ্যাৎ, ব্যক্তিগত বাজেট মেনে চলা ও ঋণ কমানো। নিয়মিত আয়-ব্যয়ের তুলনা করাটাও জরুরি।a
শেয়ার করুন :